বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি: পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে এক সমাজ
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক সংকটময় অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি এবং জনমতের সব স্তরে অনিশ্চয়তা, বিভাজন এবং হতাশার ছায়া বিরাজ করছে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়েও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যেমন পরিণত হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। বর্তমান রাজনীতি একদিকে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও দলীয় একচ্ছত্র প্রভাবের মধ্যে বন্দি, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা, অবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক অনাগ্রহের গভীর ছায়ায় আচ্ছন্ন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য শুধু দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং সমাজবিন্যাস, রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাঠামো, গণমাধ্যম, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং তরুণ প্রজন্মের মানসিক অবস্থা—সব দিকের বিশ্লেষণ জরুরি। এই প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচন, ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি নতুন রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। স্বাধীনতার প্রাথমিক দশকে দেশ গঠনের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সমাজের বিভাজন দূরীকরণ। তৎকালীন শাসকশ্রেণির নেতৃত্বে দেশের রাজনীতি সামাজিক ন্যায়, সমবায় এবং জনগণের অংশগ্রহণের দিকে কিছুটা এগোচ্ছিল যদিও তার শেষটা ছিল নৈরাজ্যকর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ জর্জরিত।
কিন্তু ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দেশের রাজনৈতিক গতিশীলতা হঠাৎ থেমে যায়। পরবর্তী বছরগুলোতে সামরিক হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকরণ, দলীয় ক্ষমতার স্থিতিশীলতা এবং বিরোধীদের ওপর দমনপ্রবণতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে দেশ বারবার সেনাশাসন এবং সাময়িক সরকারের পরিবর্তন দেখেছে। এই প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিংসতা, বিভাজন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারাবাহিক ধারা তৈরি করেছে।
১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হলেও রাজনীতির কেন্দ্রীকরণ, ক্ষমতার একচ্ছত্র দখল, এবং বিরোধী দলের ওপর মামলা-গ্রেপ্তার ও প্রশাসনিক চাপের ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিকে দখল করে রেখেছে, যেখানে নির্বাচনের প্রকৃত অর্থ—জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রভাব—ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও একতরফা রাজনীতি
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয়। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এবং নির্বাচন কমিশনের সীমিত সক্ষমতা নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করে। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দল অংশগ্রহণ না করে দাবি করে যে সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। ফলস্বরূপ, আওয়ামী লীগ একতরফা বিজয় অর্জন করে এবং সংসদে কার্যত কোনো কার্যকর বিরোধী দল ছিল না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটিকে ‘নির্বাচনী গণতন্ত্রের ছায়া’ বলে অভিহিত করেছেন—যেখানে নির্বাচন আছে, কিন্তু ভোটারদের অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জবাবদিহিতা প্রায় অনুপস্থিত। নির্বাচন কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দীপনা এবং আস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
নির্বাচনের বিশদ বিশ্লেষণ দেখায় যে, ভোটার অংশগ্রহণ কমে গেছে, ভোটকেন্দ্রে প্রভাব রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন প্রায়শই পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক দলের প্রভাবের মধ্যে। ফলে নির্বাচনের প্রকৃত অর্থ—জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রভাব—ক্রমশ হারাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা
২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে সংবিধান অনুযায়ী একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল নির্বাচনের স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন এবং রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তারা মূলত “অস্থায়ী প্রশাসক” হিসেবে কাজ করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল:
প্রশাসনিক তদারকি ও সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ
ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ ও অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি
নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ
তবে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও রাজনৈতিক চাপের কারণে তাদের কার্যক্রম প্রায়শই সীমিত ছিল। প্রশাসনিক কাঠামো ও নিরাপত্তা বাহিনী এখনও মূল রাজনৈতিক দলের প্রভাবের মধ্যে থাকায়, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম প্রায়শই আনুষ্ঠানিকতার মাত্রা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
সামাজিক আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, দলীয় প্রভাব এবং রাজনৈতিক চাপ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতাকে প্রায়শই সীমিত করেছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আস্থা
বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা দুর্বল করেছে। সংসদ, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণমাধ্যম—সবই রাজনৈতিক দলের প্রভাবের বাইরে নয়। ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বিকল্পের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। নাগরিক সমাজের একটি অংশ মনে করে, রাষ্ট্র ক্রমে একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মডেলে রূপ নিয়েছে—যেখানে বিরোধিতার স্থান সীমিত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, এবং প্রশাসন দলীয় শাসন রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আস্থাহীনতা শুধু ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি, সাংবাদিকদের ওপর চাপ, এবং সামাজিক আন্দোলনের দমন প্রক্রিয়ার মধ্যেও দেখা যায়। ফলে জনগণ রাজনৈতিক সংলাপে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করছে।
অর্থনীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত এক দশকে প্রশংসনীয় অগ্রগতি দেখিয়েছে। তবে এই প্রবৃদ্ধি অসম উন্নয়ন, বৈষম্য এবং সম্পদের কেন্দ্রীভূতির উপর ভিত্তি করে। বৈদেশিক ঋণনির্ভর অবকাঠামো প্রকল্প, রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয়—এই তিনটি অর্থনৈতিক স্তম্ভ দেশের সম্পদকে সীমিত গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত করছে।
ধনী-গরিব ব্যবধান বৃদ্ধি, শহর-গ্রামের বৈষম্য, এবং সম্পদের অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রীভূতি রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। রাজনীতি ক্রমশ ব্যবসায়িক বিনিয়োগের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ভোটার বা সমর্থকের ভূমিকায় সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং নির্বাচনী সুবিধা অর্জনের জন্য আর্থিক ও প্রশাসনিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা জনগণের প্রয়োজন ও দাবি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য শুধু রাজনৈতিক প্রভাবই নয়, সামাজিক অস্থিরতার সূচনা করেছে। অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্য, গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের মধ্যে পার্থক্য, এবং প্রাথমিক শিক্ষার অভাবের কারণে সামাজিক সংহতি কমে যাচ্ছে।
তরুণ প্রজন্ম ও সামাজিক পরিবর্তন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বিমুখ হচ্ছে। একদিকে তারা রাজনৈতিক দল ও প্রচলিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ কমাচ্ছে, অন্যদিকে সামাজিক, পরিবেশগত, এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সক্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় রাজনৈতিক চিন্তা ও আন্দোলনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭০-৮০-এর দশকে ছাত্রসংগঠনগুলো মূলত দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের চালিকা শক্তি ছিল। ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষার অধিকার, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা—সব ক্ষেত্রেই তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আজকের তরুণদের রাজনৈতিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা রাজনীতি মানে হিসেবে বর্ণনা করছে—দলবাজি, দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ এবং সহিংসতা। এই ধরণের অবমূল্যায়নের কারণে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমেছে। তবে সামাজিক মাধ্যম, যেখানে রাজনৈতিক আলোচনা প্রবল, অনেক সময় বিভাজন, ঘৃণা এবং প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে তরুণরা রাজনৈতিক আলাপের সংস্কৃতিকে আবেগ ও মেরুকরণের দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
তবুও, এই প্রজন্ম সামাজিক ও পরিবেশগত আন্দোলনে সক্রিয়। তারা নারী অধিকার, জলবায়ু ন্যায্যতা, স্থানীয় উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত। ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সামাজিক মাধ্যম তাদেরকে প্রচলিত দলীয় কাঠামোর বাইরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে। এতে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের নতুন রূপ, নতুন ধারণা এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতি জন্ম নিচ্ছে।
বিরোধী দল ও রাজনৈতিক ভারসাম্য
বর্তমান বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর রাজনীতি এক ধরনের অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। বিএনপি দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, নেতৃত্বের সংকট, মামলা-গ্রেপ্তার, সাংগঠনিক অচলাবস্থা এবং জনসংযোগের ঘাটতি তাদের কার্যক্রমকে প্রায় স্থবির করে রেখেছে। আন্দোলনের ডাক দিলেও মাঠে কার্যকর উপস্থিতি সীমিত। জনগণের মধ্যে যে হতাশা ও ক্ষোভ রয়েছে, তা এখনও কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক বিকল্পে রূপ নিতে পারেনি।
ইসলামপন্থী রাজনীতি, বিশেষত জামায়াত ইসলামি, বর্তমানে বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে অংশগ্রহণ করছে। তারা ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করে কিছু অংশে প্রভাব বজায় রাখছে, তবে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের প্রভাব সীমিত। জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায়শই সামাজিক মিডিয়া এবং প্রবাসভিত্তিক নেটওয়ার্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
বাম দলগুলোও —যারা স্বাধীনতার পর থেকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারক ছিল—প্রায় প্রান্তিক। সংগঠন ও নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং জনগণের সঙ্গে সংযোগের অভাব তাদের প্রভাবকে সীমিত করেছে। তবুও শ্রমিক আন্দোলন, কৃষি ও পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তারা নীতিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের বার্তা প্রচার করছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের মতো সাফল্য সরকারকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক পরিসরেও বাংলাদেশ কূটনীতি, শান্তিরক্ষা এবং আঞ্চলিক সংলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের আড়ালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমত দমন এবং প্রশাসনের অতিরিক্ত রাজনৈতিকীকরণ চলছে। নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর সাংবাদিক ও নাগরিকদের উদ্বেগ বেড়েছে।
সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা বলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতার সঙ্গে রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জও সমান্তরালভাবে বেড়ে চলেছে। এতে দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নাগরিক অংশগ্রহণ
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রমশ “নির্বাচনবিহীন রাজনীতি”-র দিকে ধাবিত হচ্ছে। নির্বাচন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা, ক্ষমতার স্থানান্তর প্রায় অনুপস্থিত। দীর্ঘমেয়াদে এই অবস্থা গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, নাগরিক অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তারা প্রাথমিকভাবে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে কাজ করেছে। প্রশাসনিক তদারকি, ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ, অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তি এবং বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছে নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার। তবে রাজনৈতিক চাপ, দলীয় প্রভাব এবং প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই উদ্যোগ সীমিতভাবে কার্যকর হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা ও প্রভাব
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময় প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেও তাদের কার্যক্রম প্রায়শই আনুষ্ঠানিকতার স্তরে সীমাবদ্ধ। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর দলীয় প্রভাব, বিরোধী দলের অসহযোগিতা এবং রাজনৈতিক চাপ তাদের কার্যকারিতাকে সীমিত করেছে। ফলে নাগরিক আস্থা পূর্ণরূপে পুনঃস্থাপিত হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এই সীমিত কার্যক্রম রাজনৈতিক সংলাপ এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালের বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট।
১. গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন: নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনকে জনগণের আস্থায় ফিরিয়ে আনা। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন, স্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক চাপমুক্ত করা। বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং প্রশাসনের কার্যক্রমকে দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করা।
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতি মোকাবিলা: ধনী-গরিবের ব্যবধান হ্রাস, শহর-গ্রামের বৈষম্য সমন্বয়, এবং অর্থনীতিতে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প, রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প এবং প্রবাসী আয় কেন্দ্রীভূত করার পরিবর্তে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে অর্থনীতিকে ব্যবহার করা।
৩. রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা: রাজনীতি যেন কেবল ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতিযোগিতা না হয়ে সমাজের সেবা এবং জনস্বার্থের মাধ্যম হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কল্যাণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি দায়বদ্ধ করা।
ভবিষ্যতের রাজনীতি ও তরুণ প্রজন্ম
ডিজিটাল যুগের তরুণ প্রজন্ম সামাজিক উদ্যোগ, উদ্যোক্তা কার্যক্রম, নারী অধিকার, জলবায়ু ন্যায্যতা এবং স্থানীয় উন্নয়নে সক্রিয়। তারা প্রচলিত দলীয় কাঠামোর বাইরে থাকলেও সামাজিক পরিবর্তনে আগ্রহী। এই প্রজন্মের সক্রিয় অংশগ্রহণ ভবিষ্যতে রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় রাজনৈতিক চিন্তা ও আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। বর্তমানে ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম সীমিত। সামাজিক মাধ্যম রাজনৈতিক আলোচনা প্রায়শই বিভাজন, ঘৃণা এবং প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তবে একই সময়ে এটি তরুণদের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা এবং স্থানীয় উদ্যোগে অংশগ্রহণের নতুন মাধ্যম হিসেবেও কাজ করছে।
সমাপনী: রাজনৈতিক আত্মসমালোচনা ও নতুন সূচনা
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক ধরনের আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষকেই ভাবতে হবে—রাজনীতি কাকে ঘিরে? ক্ষমতা না কি মানুষকে? উন্নয়ন কি শুধুই অবকাঠামো, না কি নাগরিক মর্যাদা ও স্বাধীনতারও উন্নয়ন?
আজকের বাংলাদেশ ইতিহাসের এক মোড়ে—যেখানে অতীতের সংগ্রাম ও বর্তমান বাস্তবতার মাঝে ভবিষ্যতের রাজনীতির বীজ রোপিত হচ্ছে। এই বীজকে লালন করতে পারলেই দেশ এগোতে পারবে নতুন রাজনৈতিক পরিণতির পথে, যেখানে শাসন, বিরোধিতা, স্বাধীনতা এবং ন্যায় একসঙ্গে সহাবস্থান করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে এসেছে যেখানে রাজনৈতিক সংলাপ, নাগরিক অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা এবং সামাজিক উদ্যোগ একত্রিত হলে দেশকে একটি স্থিতিশীল, অংশগ্রহণমূলক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা সম্ভব। অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধ হলেও তাদের কার্যক্রম প্রমাণ করেছে যে স্বচ্ছ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করা যায়।
ভবিষ্যৎ রাজনীতি এই দিশায় এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ কেবল অর্থনৈতিকভাবে সফল নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রও হয়ে উঠবে।
লেখক: বদরুল আলম
তারিখ: ১০ নভেম্বর ২০২৫
স্থান: ঢাকা

![]()